এই লাল মাঠ
এই সন্ধ্যার নড়বড়ে বাতাস
এই পানশালা থেকে ফেরার পথে শব্দহীন নাগরিক
এই জলের ওপর তেলের বিন্দুর মত কিছু
আমার ওপর ছড়িয়ে পড়া শূন্যতার মত কিছু
আমার দুঃখের রেখাগুলি
কেন বারবার আমার পায়ে জড়িয়ে যায়
কেন আবছা লাগতে থাকে
এই মোটা চশমার ওপারের সংসার?
=======
ছেড়ে তো আসিনি
আমার কম্পমান আঙুলের চিহ্ন
তোমার বক্ষে?
থেকে তো যায়নি
আমার অশ্রুর লবন
তোমার হাতের তালুতে?
হঠাৎ উপচে পড়েনি তো
আমার আগ্রহের বিম্ব
তোমার চোখে?
=======
আমি এই সূত্র কোথায় রাখি?
কোন পাতার ওপর
তোমার হাসি ছড়িয়ে আছে
আমার অঙ্কের লাইন
তোমার অঙ্কের গভীরে বিলীন হচ্ছে
না, তুমি তো রাধা না
তুমি শুধু ঘাটে
নিজের পা দিয়ে ছপছপ করেছিলে
তুমি শুধু ঘাটে
কিছু ক্ষণ…
=======
অঙ্কের ওপর ছড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও
তোমার শরীর লোপ পায় না
তুমি আমাকে নিজের শরীরের প্রতি টুকরো থেকে
ঠিক সেই ভাবে দেখছ
যেমন সেই দিন যাবার সময় দেখেছিলে
=======
আওয়াজ কি ডুবতে পারে
দুঃখের নিস্পন্দতায়?
শরীর কি লোপ পেতে পারে
দেহের ভাঁজে আটকে থাকা অশ্রুর মধ্যে?
এই আমার শেষ চিৎকার কোথায় গেল?
প্রায় এক বছর গলায় আটকে রইল
তার পর রঙের মধ্যে ঘুরে বেড়াল
এখন ঝরেই চলে
প্রতি কোষ থেকে, আঙুল থেকে
ওষ্ঠের বুদ্বুদ থেকে
=======
এই আমি সন্ধ্যার আকাশে
কিসের খোঁজ করছি?
হয়তো বা ঘরে ফেরা পাখির পংক্তি
তোমার উড়ন্ত শাড়ির আঁচলের
কিনারা হয়ে যেতে পারে
অস্তগামী সূর্যের দিকে মুখ করে
কেন দাঁড়িয়ে থাকি?
হয়তো বেগে নিভন্ত কিরণে
তোমার মুখের পর ডুবন্ত
শেষ হাসি আকার নিয়ে নেবে কখনো বা এসে?
কিন্তু কখন?
এই আমার হাতে অযথা
ঝুলন্ত ছাতা জেনেও
চুপ করে থাকে
=======
না হয় মানলাম আকাশ শুধু এক ফালি শূন্যতা
পাখিরা শুধু সংখ্যা
মানলাম আমার বেঁচে থাকাটাই একটা প্রশ্ন
তবু কেও তো আছে
যে জট ছাড়াতে পারে
কেও তো আছে!
=======
এদিক ওদিক ছড়ানো অক্ষর থেকে
কিছু বেছে নিয়ে আমার নাম করা
যেন বৃত্ত কে বর্গ করা
যে কোন মুহূর্তকে তোমার নাম ছাড়া
চলে যেতে দেওয়া
যেন নিজের ছায়াকে পেছনে কোথাও
ফেলে রেখে
আগে বাড়ার ইচ্ছে পোষণ করা
ছড়ানো ছিটনো অক্ষরের ছায়া থেকে
বার হয়ে এসে জানি না কেমন করে প্রতি রাত
এই শূন্য পালঙ্ক পর্যন্ত পৌঁছে যাই
=======
তুমি কি কখনও আমায় দেখেছিলে
নাকি শুধু তোমার চলে যাওয়া
আমার দিকে ফিরে তাকায়
এই উঁচু-নিচু জমির ওপর
বিন্দুর সারি কেমন আলাদা
আলাদা কোণে পড়ে
ওটা তোমার নীল আঁচলই ছিল
না কি তুমি ওখানে ছিলে না বলে
ভেবেছিলুম হবে হয়ত কোন উড়ন্ত সমতল?
=======
তুমি কি এখনও ফুলের ওপর
পা পড়ে গেলে চিৎকার করে ওঠো?
মাথার আঘাত কি এখনও
এক দিকের আলগা চুল দিয়ে ঢাকো?
গরুর দুধ দোহন শেষ হলেই
এখনও কি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদো?
এখনও যখন চিলের ছায়া পরে ঘাসের ওপর
তাকে ধরবে বলে দৌড়ও?
=======
আমার কাছে রাখা স্মরণিকার মত
তোমার স্পর্শের অন্তিম কণা
বছরের পর বছর এলোমেলো ঘুরেছে
আমার অঙ্কের পর
তারপর অশ্রুতে কখন বয়ে গেছে সে
এই ভাবে
আমি দ্বিতীয় বার একলা হয়ে গেলুম
উদয়ন বাজপেয়ি (জন্ম ১৯৬০) চোদ্দোটির বেশী বই লিখেছেন – তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘কিছু বাক্য’ (কবিতা); ‘বালির ধারে বাড়ি’ ও ‘দূর দেশের গন্ধ’ (ছোট গল্পের সংকলন); ‘জনগড় কলম’ (আদিবাসী শিল্প ও লোককথার বিষয়ে)। উনি নাটক ও চিত্র-নাট্য ও লিখেছেন। নাম-করা নাট্য পরিচালক কে. এন. পানিক্কার ও রতন থিয়াম-এর ওপর দুটি বই লিখেছেন । চলচিত্রকার মণি কাউল, ইতিহাসবেত্তা ধারামপাল, তত্ত্ববিৎ নভজ্যোৎ সিং, হিন্দি কবি কমলেশ-এর সাথে তার সুদীর্ঘ কথোপকথন বই-আকারে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর লেখা পনেরোটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে, তার মধ্যে ফরাসি, পোলিশ, ইংরেজি, সুইডিশ, উড়িয়া ও মালায়ালম। তিনি কলা, সাহিত্য ও সভ্যতা-সংক্রান্ত পত্রিকা ‘সমাস’-এর সম্পাদক। তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন। প্যারিস ও ল্যাভিনি (সুইজএরল্যান্ড)-এ ‘রাইটার-ইন-রেসিডেন্স’ ছিলেন আর ইনস্টিটিউট অফ এডভান্সড স্টাডিস, নান্টেস-এ ‘ফেলো’ হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন।
ছন্দক চট্টোপাধ্যায়, জন্ম ১৯৩৫। শিক্ষাবিদ, ইংরেজি পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা, অনুবাদক ও কবি। পড়াশোনা শান্তিনিকেতন ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ইংরেজি পড়িয়েছেন আফ্রিকা ও ভারতের নানা জায়গায়। চাকরি-জীবন শেষ করেন কানপুরের এয়ারফোর্স স্কুলের অধ্যক্ষ হিসেবে। তাঁর সাম্প্রতিক বইগুলির মধ্যে রয়েছে ‘গেট আ গ্রিপ অন ইংলিশ গ্রামার’ (স্কলাস্টিক, ২০১৫); কবিতার বই ‘সামার নোজ’ (সম্পর্ক, ২০১৫); ইংরেজি অনুবাদে জীবনানন্দ দাশের ছোট গল্পের সংকলন ‘থ্রি স্টোরিস’ (পেপার ওয়াল, ২০১৬); ইংরেজি অনুবাদে ‘সিক্স বাংলা পোয়েট্স’ (পোয়েট্রিওয়ালা, ২০১৭); নিজের ছোট কবিতা ও জাপানি জেন কবিতার সংকলন ‘আমরা তিনজন’ (বাহান্ন প্রকাশ, ২০১৮)।