প্রতিদিন তব গাথা
রংমাখা সবুজ মুখে চোখ শুধু
প্রাণ
বর্ণবিবেচনায় হেরে যাওয়া অবয়ব
স্থিমিত
বুক ফেটে রক্তক্ষরণ করে
সুর
একটা ভলভো দোটানা চালিয়ে নিয়ে যায়
দিনলিপি।
যেদিন কান্না আসে ঘরে
খাঁচা ঠিক না থাকলেও বা কি
কোণে বেড়ে ওঠা মাকড়সার জাল
বলে দেয়, গাছ…
…ছায়া নীল হতে হতেও
পারেনি হতে এক চিলতে সবুজ ঋণ।
তবু, উন্মুক্ততার বিনম্রতায় গোটা কফিশপের মাথা হেঁট হয়ে যায় –
সেই সব দিন
উপস্থিতি বুঝে যাওয়া সাপ
ধীর।।
অগ্রন্থিত দিনলিপি
১
যে বিশাল দ্বীপ মহাবিশ্বের বুক চিড়ে আছে,
সেটা আসলে একটা পাঁচিল। আলোকবর্ষ গেঁথে তৈরি সে দেওয়ালে
চুনোপুটি ব্রহ্মাণ্ড সেঁটে আছে। গমের দানার মতন। পরতে পরতে প্রেম,
আধো বুলি, ঊন্মাসিক কল্পনা।
তোমাদের কাছে কাঁচ টলটলে হলে, সেখানে ছিপ ফেলো;
ভুলে যাও হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির পর্দায় এখনো কিলবিল করে নিস্বর্গ,
অপেক্ষা শুধু সময়ের ফিরে চলার।
যদি বা কয়েক পারসেকে ফিরে চাওয়া যায়, ঊনিশ ট্রিলিয়ান মাইল
সময়ের মহীরূহকে রগড়ে রগড়ে গড়িয়ে দেয় :
ইতিহাসে যেখানে ছিলাম আমি, সেই আমির বিন্দু খুঁজে খুঁজে
সৌরমণ্ডল ঘুরি; স্যাঁতস্যাঁতে কাঁচ বাথরুমে বলে,
“এবার বিশ্রাম নাও উল্টানো ঠোঁটের ফরাসি সম্বোধনে-
মরীচিকা সত্যির আরেক নাম।”
২
একচেটিয়া প্রেমের সপসপে চাহিদা পেরিয়ে
বেহাগের কামনা কামড়ে ধরে।ছোটো ছোটো কাঁকড়ার
শাঁস থাকে না, তবু তো নাম বাগিয়ে বৃহন্নলা-
লেলিহান ভূগর্ভের দিকে চাইলে কড়াইশুটি দেখা যায়;
দানার কাণ্ডে আগুনের তাত নেই,
এমত জীবনীশিল্পে প্রত্যেকটা সুবাস ক্রমবর্ধমান, তবু,
জ্যামিতিক হিসেবে শূন্য আরো বড়ো,
আয়নায় দেখা অন্য সূর্যদের মতন।
সোনাঝুরির রূপকথারা
অবর্ণনীয় ব্যাথার পুকুর বা পাকস্থলী হয়ে যায়
রাতদুপুরে, ভরা বসন্তে; সোনালী বেদনার চুল
আলগোছে নেমে আসে,
পাকানো দড়ি-
কয়েক স্বর্ণ বলয় পেরিয়ে যখন আবার থামা, তখনও
শোচনীয় মায়ায় গর্ভযন্ত্রণা: কিসের, কি ক্ষণের
আবেগে গোটা সমুদ্র ধেয়ে আসে, তা জানা আছে বলেই না এত সংবরণ শক্তি!
পাকানো স্বপ্ন বেয়ে উঠে যায় রাত্রি, নেমে আসে ভোর সময়ের অন্তরায়ে,
যেখানে যখন খনি বুকে নিয়ে যেতে বলে, চলে যায়-
এবারেও সব শেষে প্রতিদিনের দীনতা দাঁড়ায়,
খোলা বুকে, এ মাসের গ্লানি নিয়ে। হাঁটা পথ চুঁইয়ে, এবারেও ধৃতিমান
অবনত,
আপেক্ষিক পরিবেদনার প্রাচূর্যে।
প্রেম-অপ্রেম
তন্ময় চৈতালি সন্ধ্যায়, একটা পরত পরে যায়;
তার পর থেকে মেঘ গায়ে শাড়ি
যেন পৃথক সম্প্রদায়। এরপর, নৃশংস ব্যভিচার
উন্মাদনার, ঠুনকো কাজে বেজায় হৃদ্যতা,
কানার জন্য ব্যতিব্যস্ত পায়ের পাতা-
:
কোনো মেঘ বজ্র হয়ে যায়,
কোনো বাজ মিটমিটে সঙ্গীত;
আদেখলার কোল ঘিরে একতান,
অন্যথা বৃথাই গুমরাহ।
কেচ্ছা কাহিনী
কাঁচের পাঁচালিতে শুষে নেওয়া আকাশ দেখে
ভয় লাগে বেপরোয়া বারোয়ারিদের :গায়ে
ছেঁকা লেগে পালিয়ে যাওয়া বেড়াল।
যাদের ঘর পুড়েছে, গা পুড়েছে
আজ কাল আগামী পুড়েছে খোদ
ভিনদেশের ঘাটে, তাদের আকাশ
চোখ ঝলসানো কাঁচ ই তো-
ভাটিয়ালীর স্রোতে তাদের পায়ের রূপো ভেজে না
ঝাড়বাতির চুরিচামারিতে দোর ভাঙে না…
ঝোড়ো পাতার ন্যায় নেই, অন্যায় নেই
বৃষবৃক্ষের এ হেন ক্ষোভের ভয় নেই।
বুকে তবু পশম আছে, মাথায় কাঁচের ঝুঁটি নাচে
হাতে মুগুর-চূড়ি কাটে
নিঁখুত ভাবে চামড়া থেকে চামড়াটাকে-
আরাম কেদারায় দেখা স্বপ্নাংশ
When you are not physically starving, you have the luxury to realize psychic and emotional starvation- Cherrie Moraga
জ্যান্ত শরীরে পোড়া আগুন
বিপন্ন বোমার শার্পেনেলের মতন-
ভাঙচি কেটে পালিয়ে বাঁচা ভালোবাসার মতন,
আড়চোখে লোভ দেয়… জ্যান্ত শরীরে…
আকাশের লালা গড়িয়ে গড়িয়ে জমে
অগ্ন্যুতপাতের আশায়;
কিন্তু, এখনো বোমা, শরীর, চোখ,
সাঁঝবেলার শূন্যতা থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে,
পালকির অপেক্ষায়; ধিক-ধিক ঘুম
আগুনের মুখে শেষ চুমু দেবে বলে।
তারপর, শরীর, ঘাম, রোদ্দুর, মৃত্যু
সব্বাই নিরস্ত্র হবে।
রাত্রের ক’জন
খুলে রাখা বুক নিয়ে শুয়ে থাকি
কে কখন আসবে,
হৈমন্তিক বুকে শুশ্রূষা করবে যতনে,
কাশফুল ঘাম ঝরবে, লকলকে জিভ ঘ্রাণ নেবে
কূপমণ্ডূক শালীনতার। তারপর ইতর ব্রাহ্মণ
কমণ্ডলু থেকে পুণ্য উড়িয়ে বলবে, “ওম শান্তি ওম”।
জঠরে তখনো বেদনা দানবের স্মৃতি হাসে;
খুলে রাখা বুক নিয়ে শুয়ে থাকি,
কে কখন আসবে, চৈতন্য হবে।।
প্রসঙ্গ প্রতিবেদন
_তম প্রেমিক বলেছিল, শ্রোণী তে প্রেম আমার
বকচ্ছপ আলিঙ্গনে, মুখ তুলে আঙ্গুলের ডগায়-
সেদিন থেকে দিনের আবাহনে এক দঙ্গল উষ্মা
হানা দিয়ে যায়
উপাংশু জীবন বৃত্তে সেই যেন সরোদের দরদী কান্নাড়া ।
তারপর কৌশিক প্রেম বয়ে গেলে
চুয়াল্লিশ বছরের ক্ষয়ে যাওয়া আয়না তুলে দেখি
এ কেমন উপত্যকা যা প্রেমে সজীব হয়!
তখন উপঢৌকন সরিয়ে একটুকু প্রেম রাখি
মেছো বেড়ালের ল্যাজ কেটে মাছে ঢেকে ।
বুঝে যায় যদি সে
তাহলে মুক্তি নেই এ সমান্তরালে।।
এমত যাত্রায় জীবন কৈশোর
ছানা হয়ে যাওয়া হলুদ কমলা
দেওয়াল থেকে দেওয়ালে
চোখ মেখে নেয় সবুজ
এখানে জীবনের অনন্ত কৈশোর ।
শরীর যে দাগগুলো ঢেকে রাখার তারা আজ
সূর্যের সারথি, মেদবহুল কারণে সুস্পষ্ট।
নগ্ন, পিঠ ঠেকিয়ে হেলান
বইএর পিঠ থেকে শব্দের ধোঁয়া, এঁড়ে তর্কে চেয়ে থাকে
উপ্যতকা থেকে উপ্যতকা –
প্রাচীন জুতোর সুকতলা চটকে
সময় ঝাঁঝরিতে আটকে যায়,
ভবিষ্যত জোঁক হয়ে মাটির দিকে মুখ
নামিয়ে নেয়…
যা নেই তার প্রান্তিক প্রশ্নের উত্তর ভেসে ওঠে
ফুটপাতে চালান করা দু’টাকার জন্মে।
আর আমরা পিঠ ঠেকিয়ে শুই, হেলান দিয়ে আরবার।
যে দিন থেকে স্বপ্ন আর আসেনি
কেউ বিশ্বাস করেনি যাত্রিলয় থেকে দেখতে পেয়েছিলাম আলোকবৃত্তের সেফালি সিঁড়ি বেয়ে
উঠে যাচ্ছ তুমি, রক্তাক্ত শিরদাঁড়া ঢেকে, পুনরায় প্রবৃত্তি যাতে না ডাকে –
কি সুন্দর বিষবৃক্ষ রোপনের বিদ্যা নিয়ে চলে যাচ্ছিলে,
ফেলে দিয়ে কোটি জোড় করের রক্ষণাবেক্ষনের ভ্রূক্ষেপহীন বিশ্বাস।
মাটি
যখন মাটির মধ্যে মাথা গুঁজে দেয় জীবন,
দম-বন্ধ লাগে নাকে চোখে কানে মাটি গড়িয়ে ঢোকে
মুখে বিষাদ সোঁদা মাটি-
উগড়ে ফেলার যায়গা নেই!
যখন মাটির মধ্যে গা ছড়িয়ে শেকড়-বাকড় হাঁটে,
কিলবিলিয়ে জীবন তখন মাটির থেকে তাতে
ঊর্ধ্বস্বরে দৌড়ে যায়-
বিরামহীন আবেগে।
মাটির মধ্যে মৃত্যু আছে
মাটির মধ্যে গর্ভ
মাটির মধ্যে অন্ধকারে
বাড়ে রোদের গল্প …
সব কিছু জীবনে
না এ শুরু, আর
মৃত্যুর দন্তন্য ন এ শেষ।
ঘাড় মটকে ঝুলে থাকা
আত্মঘাতী শব
বা, আততায়ীর অভিসারে
গান্ধারী রব-
যাই হোক একটাই ইতিহাস সব
না এ শুরু
আর দন্ত্যন এ – দপ!
সুস্মিতা পাল – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্য নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশুনা। লেখালেখি বহুদিন অব্দি নিজের নোটবই-এ সীমাবদ্ধ ছিল। কৌরবের হাত ধরে ধারাবাহিক প্রকাশনায় আসা। সাম্প্রতিক কালে তাঁর লেখায় জড়িয়ে থাকে দীর্ঘদিনের অবসাদ ও স্কিজোফ্রেনিয়া থেকে উত্তরণের উপলব্ধি ও মাতৃত্বের গভীর চেতনা। তাঁকে লিখতে পারেন এই ঠিকানায় – susmitapaul.writer@gmail.com
‘প্রতিদিন তব গাথা ‘ কবিতায় কি ‘স্থিমিত’ শব্দটি কি ‘স্তিমিত’ হবে ? নাকি ‘স্থিমিত’ অন্য একটি শব্দ ।